মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০২৪

পঞ্চগড়ে ভিতরগড় দুর্গনগরী বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত

 
বদরুদ্দোজা প্রধান পঞ্চগড় প্রতিনিধি: দক্ষিণ এশিয়ায় সর্ববৃহৎ দুর্গনগরী ভিতরগড়। ভিতরগড় নিয়ে এখনো অনেক কিছু অজানা। অথচ প্রত্নতাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক পর্যটনের সম্ভাবনা অনেক। দুর্গনগরী ভিতরগড়ের সম্ভাবনা, সংকট ও প্রস্তাবনা বিষয়ে সেন্টার ফর হেরিটেজ স্টাডিজ এর সহযোগিতায় প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘কারিগর’ মঙ্গলবার পঞ্চগড় জেলা পরিষদ মিলনায়তনে ‘‘অপার সম্ভবনা: ভিতরগড় বাংলাদেশে পরিবেশ বান্ধব সাংস্কৃতিক পর্যটনের একটি অনন্য প্রত্নস্থল’’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর হেরিটেজ স্টাডিজ এর পরিচালক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুসনে জাহান। তিনি তাঁর প্রবন্ধে পাওয়াপয়েন্টের মাধ্যমে স্থির চিত্রের মাধ্য ভিতরগড়ের সংক্ষিপ্ত অতীত, বর্তমান ইতিহাস এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা তুলে ধরেন। প্রবন্ধে তিনি বলেন,  চারটি আবেষ্টনী দেয়াল দিয়ে পরিবেষ্টিত ভিতরগড় দুর্গনগরী বাংলাদেশে অদ্বিতীয়। এখানে স্তম্ভবিশিষ্ট বারান্দাসংবলিত স্থাপনাটি বাংলাদেশে আবিষ্কৃত এ ধরনের একমাত্র স্থাপত্যিক নিদর্শন। ভিতরগড়ে আছে চাষাবাদের জন্য সেচব্যবস্থা ও নদীর পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাথরের বাঁধ নির্মাণের অনন্য উদাহরণ। মহারাজার দিঘির ইট বাঁধানো দশটি ঘাট ও ঘাটের উভয় পাশে ইট ও মাটি দিয়ে নির্মিত সুউচ্চ পাড় অসাধারণ নিদর্শন। এখানে পরিবেশ বান্ধব পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা, যাদুঘর প্রতিষ্ঠা, হেরিটেজ মেলা ও স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলা আয়োজন করার কথা জানান। আর স্থানীয়দের উচ্ছেদ করে নয়, তাদের সাথে নিয়ে এটা করতে চান এবং এসব করা সম্ভব।

  অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু সাঈদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পঞ্চগড়—১ আসনের সংসদ সদস্য নাঈমুজ্জামান ভুইয়া মুক্তা, বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান শেখ, পঞ্চগড় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দেলওয়ার হোসেন প্রধান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম শফিকুল ইসলাম। কারিগরের পরিচালক সরকার হায়দারের সঞ্চালনায় অধ্যাপক (অব.) হাসনুর রশিদ বাবু, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন প্রধান, লোক গবেষক ও লেখক নয়ন তানবীরুল বারী, জেলা পরিষদ সদস্য আকতারুন নাহার সাকী ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম শহীদ আলোচনায় অংশ নেয়। বক্তারা প্রস্তাবিত পরিকল্পনার সাথে একমত পোষণ করে কতিপয় সুপারিশ পালা পেশ করেন।

 ভিতরগড় দুর্গনগরী পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর—পূর্বে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের ভারত—বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে অবস্থিত। ২০০৮ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) অধ্যাপক ও প্রত্নত্ববিদ ড. শাহনাজ হুসনে জাহান নিজ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভিতরগড়ে গবেষণা ও খননকাজ শুরু করেন। কয়েক দফা খননে বেরিয়ে আসে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসহ ছয়টি প্রাচীন স্থাপনা। এখানে দুটি মন্দিরসদৃশ স্থাপনার সন্ধান পায়। ধারণা করা হচ্ছে, এসব স্থাপনা অষ্টম শতকে ভারতীয় বাস্তুশাস্ত্র অনুসরণ করে নির্মিত। এযাবৎ আবিষ্কৃত আটটি স্থাপনার ভিত্তি কাঠামো থেকে লাল ও ধূসর রঙের নকশাখচিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, লোহা ও তামার তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রের মধ্যে আছে থালা, বাটি, হাঁড়ি ও মাটির প্রদীপ। খননের পর স্থাপনাগুলো আবার প্রত্নতাত্ত্বিক কায়দায় মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।

ভিতরগড় দুর্গনগরীর বাইরের আবেষ্টনীর উত্তরাংশ, উত্তর—পশ্চিমাংশ এবং উত্তর—পূর্বাংশ বর্তমানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত হওয়ায় ধারণা করা হয়, ষষ্ঠ শতকের শেষে কিংবা সপ্তম শতকের শুরুতে ভিতরগড় স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাণিজ্য সড়ক ও নদীপথের ওপর অবস্থিত হওয়ায় ভিতরগড় এলাকার অধিবাসীরা সম্ভবত নেপাল, ভুটান, সিকিম, আসাম, কুচবিহার, তিব্বত, চীন, বিহার এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। ভিতরগড়কে রক্ষায় নির্দেশনা চেয়ে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’—এর পক্ষে ২০১১ সালের ১৪ জুন উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন আইনজীবী মঞ্জিল মোরশেদ। এর পরিপেক্ষিতে ভিতরগড় দুর্গনগরীকে কেন প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা ঘোষণা দেওয়া হবে না মর্মে একটি রুল জারি করেন আদালত। একই সঙ্গে ভিতরগড় প্রত্নসীমার ২৫ বর্গকিলোমিটারজুড়ে সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ওই এলাকায় সব ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের ওপর নজরদারি বাড়াতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু আদালতের আদেশ অমান্য করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে টোকাপাড়া বিজিবি ক্যাম্প, স্যালিলান টি এস্টেটসহ প্রত্নসম্পদ ধ্বংসকারী একাধিক চা—বাগান, মাজার, দোকানপাট ইত্যাদি।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: